কুইক রেন্টালে বিপিডিবির লোকসান ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে
লোকসানের ভারে ডুবতে বসেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। সরকারি এই সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর গত ২০১২ সালের ৩০ জুন এই লোকসানের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ২০০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এক হিসাবে প্রতি মাসে বিপিডিবি লোকসান দেয় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত ‘কুইক রেন্টাল পাওয়ার’ কোম্পানি থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে তা কম দামে বিক্রি করায় প্রতি বছরই সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। লোকসানের কারণে সংস্থাটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের করও পরিশোধ করতে পারছে না। যেমনÑ বিপিডিবি কর্তৃক ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) আরো ১০ ভাগ শেয়ার বাজারে ছাড়ার কথা ছিল অনেক দিন আগেই। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী এই পরিমাণ শেয়ার ছাড়ার জন্য কর পরিশোধ করতে হবে। লোকসানি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে বিপিডিবি কর পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে ২০১১ সাল থেকে ডেসকোর অতিরিক্ত শেয়ারও বাজারে অবমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে লোকসানি প্রতিষ্ঠানের কথা বিবেচনা করে তাকে যেন কর অব্যাহতি প্রদান করা হয় সে জন্য আবেদন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে আবেদন করা হবে বলে জানা গেছে।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে ২০১১-১২ অর্থবছর পর্যন্ত (মোট পাঁচ অর্থবছর) সংস্থাটির নিট লোকসানের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৭৬০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এই লোকসানের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথম তিন অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার নিচে ছিল। কোনো অর্থবছরে লোকসান বাড়লেও পরের অর্থবছরে তা হ্রাস পেয়েছে। যেমনÑ ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বিপিডিবির নিট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৯৮২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৮২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। তার পরের ২০০৯-১০ অর্থবছরে লোকসান আরো কমেছে বলে পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে। সে বছর নিট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৬৩৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু পরবর্তী দুই অর্থবছরের লোকসানের পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মূল কারণ চড়া দামে বেসরকারি খাত থেকে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেনা।
২০১০-১১ অর্থবছরে বিপিডিবির লোকসানের পরিমাণ দেখানো হয়েছে চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে লোকসান বেড়ে হয়েছে ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট থেকে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে খরচ পড়ছে ১৪ থেকে ১৭ টাকা। কিন্তু গ্রাহকপর্যায়ে বিক্রি করা হচ্ছে সাত থেকে আট টাকার মধ্যে। এখানে অর্ধেকই ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ভর্তুকির যে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে তার ৮০ শতাংশই দিতে হচ্ছে কুইক রেন্টাল থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনায়। বিদ্যুতের দাম আর বৃদ্ধি করা না হলে চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই সংস্থার লোকসানের পরিমাণ সাত হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ দিকে লোকসানের কারণে ডেসকোর শেয়ার ছাড়ার জন্য যে আয়কর দেয়ার কথা রয়েছে তাও দিতে পারছে না বিপিডিবি। গত সপ্তাহে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জ্বালানি সচিবের কাছে এ সম্পর্কে একটি চিঠিও পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১ সালে মার্চ মাসে জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে বিপিডিবিকে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে ডেসকোর আরো ১০ ভাগ শেয়ার যেন বাজারে ছাড়া হয়। পরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই পরিমাণ শেয়ার বাজারে ছাড়তে হলে আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ এর ধারা ৫৩এম অনুযায়ী কর পরিশোধ করতে হবে।
এরপর জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ মোতাবেক এনবিআরের কাছে একটি পত্র পাঠায় বিপিডিবি। সেখানে বলা হয়, বিপিডিবি একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে তার পক্ষে আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী ডেসকোর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শেয়ার অফলোডের জন্য কর পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী অবশ্যই বিপিডিবিকে কর পরিশোধ করতে হবে। এখানে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এখন আবার বিপিডিবি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছে তারা যেন অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে, এনবিআর যেন কর অব্যাহতি দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে।
এ ব্যাপারে বিপিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, কর অব্যাহতি দেয়া না হলে ডেসকোর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শেয়ার হয়তো চলতি বছরে আর শেয়ারবাজারে অফলোড করা সম্ভব হবে না। কারণ কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলোর কাছ থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ কেনার কারণে এবার লোকসানের পরিমাণ হয়তো আরো বৃদ্ধি পাবে। তাই এনবিআরের উচিত বিষয়টি বিবেচনা করা। এ ব্যাপারে শিগগিরই একটি বৈঠকের কথা রয়েছে বলে তিনি জানান। প্রসঙ্গত, বর্তমানে ডেসকোর ২৫ শতাংশ শেয়ার বাজারে রয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন