বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা_ বাংলাদেশের সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা হচ্ছে। তারা কি দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন, রাজনীতি থেকে অবসরে যাবেন, না স্বেচ্ছায় বিদেশে চলে যাবেন_ এসব নিয়ে অনেক আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে, এখনো হচ্ছে নানা মহলে। সর্বশেষ, গত সোমবার বিবিসির সংলাপে দুই দলের দুই জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, প্রয়োজনে দুই নেত্রীকে বাদ দিয়েই সংস্কার করতে হবে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের গ্রেফতার হওয়া নেতাদের কাছ থেকে তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অবৈধ অর্থ-চাঁদা-সম্পত্তি সংগ্রহ এবং বাসে আগুন দেওয়া ও খুনের মামলা চাপা দেওয়াসহ বহু ব্যাপারে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। ক্ষমতায় থেকে বা ক্ষমতার বাইরে গিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল দুটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের চাঁদা আর দুর্নীতির যে রূপ বের হয়ে আসছে, তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। এসবের অনেক কিছুই আমরা জানতাম, সমাজে আলোচিত ছিল, তারপরও সত্য এত ভয়ঙ্কর যে, পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো সবাইকে যুগপৎ গভীরভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। কিন্তু বেগম জিয়া বলেছেন, 'আমার ও আমার পরিবার সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।' শেখ হাসিনা বলছেন, 'জীবনে কাউকে এক টাকাও দিতে বলিনি। কারো কাছে চাঁদা চাইনি।' তবে দুই নেত্রীর এসব কথা কেউ বিশ্বাস করেন না। এখন আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি।
কিছু দিন আগে আইন ও তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছিলেন, দুই দলের নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ীই সরকার দুই নেত্রীর ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ (দুই নেত্রীকে দেশের বাইরে পাঠানো) নিয়েছিল। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে পরামর্শদাতাদের নাম প্রকাশের অনুরোধ জানানো হয়। জবাবে মইনুল হোসেন পরামর্শদাতাদের নাম প্রকাশ না করে আবারও একই কথা বলেন। তবে তিনি বলেন, দুই নেত্রীকে দেশে রেখে বা দলের শীর্ষে রেখে সংস্কার করা যাবে কি যাবে না_ এ ব্যাপারে দলের মধ্যে দুই রকম মত থাকতেই পারে। তিনি নাম প্রকাশ করেন আর না-ই করেন, তার এ বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক ও সুধীমহলে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
তবে এ কথাটি সত্য, বিএনপি ও আওয়ামী লীগে এমন অনেক নেতা ও কর্মী রয়েছেন, যারা দলে সংস্কার চান, পরিবারতন্ত্রের অবসান চান, দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। তারা বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বেরও পরিবর্তন চান। তবে দুই নেত্রী দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে এসব কিছু হবে না বলে তারা মনে করেন। মাঠ পর্যায়ের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যেও এ রকম মনোভাব রয়েছে। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে দুই দলের ভেতরে ও বাইরে বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনাও হয়েছে। দুই দলেরই বড় নেতারা এ রকম মতামত ব্যক্ত করেছেন অপ্রকাশ্যে। তাদের কাছ থেকেই আমরা এসব কিছু শুনেছি, জেনেছি। কিন্তু তারা এতদিন প্রকাশ্যে কিছু বলতে বা কোনো অবস্থান নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেননি। তারা এখন কিছু কিছু কথা বলছেন।
সর্বশেষ, যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলের জেরার মুখে আইন-শৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক দুই বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং বড় ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য ও বক্তব্য থেকে দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির যেসব তথ্য বের হয়ে আসছে, তাতে আবার প্রধান দুই নেত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ কথা বেশ জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে, যারা দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছেন, যারা দলের জন্য ও নিজের জন্য বহু সম্পদ গড়ে তুলেছেন, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যা-খুনের সঙ্গে জড়িত; তাদের নেতৃত্বে রেখে দল বা দেশের জন্য কি লাভ হবে? ১৫ বছর ধরে সরকার ও বিরোধী দলে থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দেশকে প্রায় ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছেন। বিএনপির বিগত সরকার যারপরনাই ক্ষতি করেছে দেশের। ২২ জানুয়ারির নির্বাচন হলে দেশে আরও সর্বনাশ হতো। কোনোভাবে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের আরও ভয়ঙ্কর রূপ আমরা দেখতাম। আর কোনোভাবে আওয়ামী লীগ জিতে গেলে তারাও আগের রেকর্ড ভঙ্গ করত। তার সব লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল।
আমাদের মনে আছে, ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ব্যাংকক থেকে প্রকাশিত খ্যাতিসম্পন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন এশিয়া উইক-এ দুই নেত্রীকে নিয়ে একটি সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল। 'একটি নতুন শুরু' (এ নিউ স্টার্ট) শিরোনামের নিচে দ্বিতীয় শিরোনাম ছিল 'বাংলাদেশের বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার সরে দাঁড়ানো উচিত'। ওই সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়েরই মে মাসে ('৯৬ সাল) অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি্বতা না করে রাজনীতি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। এ সম্পাদকীয় মন্তব্য নিয়ে তখন এবং পরবর্তীকালেও কিছু আলোচনা হয়েছিল। এ সম্পাদকীয় লেখার পটভূমি ছিল '৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপির ব্যর্থ শাসন, অকার্যকর সংসদ, আওয়ামী লীগের সংসদ বর্জনসহ হরতাল-অবরোধ ও একগুঁয়ে বিরোধিতা, দেশব্যাপী সংঘাত-সংঘর্ষ, প্রধান বিরোধী দলের বর্জন সত্ত্বেও মধ্য ফেব্রুয়ারির বিএনপির নির্বাচনী প্রহসন ও জনগণের প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি।
আমাদের মনে আছে, '৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগ কখনো বিএনপি সরকারকে মেনে নেয়নি। শুরু থেকে সরকার পতনের লক্ষ্যে তারা তাদের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। '৯৪ সাল থেকে অব্যাহতভাবে সংসদ বর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ। তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল দুর্নীতিপরায়ণ জাতীয় পার্টি ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী। হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে তৎকালীন বিএনপি সরকারের পুরো মেয়াদ পর্যন্ত সব সময় দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা হয়েছিল। ওই সময়ে সংঘাত-সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। আর বিএনপির শাসন-পরবর্তী সময়ের (২০০১-২০০৬) চেয়ে তখন কিছুটা সহনশীল হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা ও দুর্নীতির বহু অভিযোগ উঠেছিল।
আমাদের মনে আছে, শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন বাতিল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিতে এবং আবার সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। তারা ক্ষমতায় এসে আগের পাঁচ বছরে বিএনপি যা যা করেছিল তারই পুনরাবৃত্তি করে, তবে আরও বেশি মাত্রায়। শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, প্রশাসনের দলীয়করণ, বিরোধী দলকে অগ্রাহ্য করা ও দমন-পীড়ন চালানো প্রায় সবই হয়েছিল। এর সব কিছুতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলীয় নেতা-মন্ত্রীরা সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপিও আওয়ামী লীগের মতোই একইভাবে হরতাল-অবরোধ, সংসদ বর্জন, সংঘাত-সংঘর্ষের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করেছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্থবির করেছে, দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সর্বশেষ, ২০০১ সালে আবার বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। কিন্তু চরিত্রের কোনো বদল হয়নি। বরং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নেতৃত্বে অর্থ-সম্পদ বিত্তের আকাক্সক্ষা আরও উদগ্র রূপ নেয়। শুরুতেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। দুর্নীতি লাগামহীন হয়ে পড়ে। প্রশাসনে নির্লজ্জ দলীয়করণ করা হয়। নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, বিচার বিভাগসহ কোনো কিছুই চরম দলীয়করণ থেকে রক্ষা পায়নি। সারাদেশে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বন্যা বয়ে যায়। খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার নেতৃত্বে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতারা দেশব্যাপী নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, লুট, জমি দখল ও দেশি-বিদেশি সূত্রে শত-সহস কোটি টাকা সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়েন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় ধর্মীয় জঙ্গিবাদ, দেশব্যাপী বোমা- গ্রেনেড হামলা প্রভৃতি। এগুলোর পেছনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আমরা দেখতে পাই। বিরোধীদলীয় নেতার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২২ নেতাকর্মীর মৃত্যু ও তিন শতাধিক লোকের আহত হওয়া, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ অনেক বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে হত্যার ঘটনায় আমরা তদন্ত আর বিচারের নামে প্রহসন দেখতে পেয়েছি। সন্ত্রাস-দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ দলের সর্বোচ্চ পর্যায়কে সরাসরি জড়িত হতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও ব্যবহৃত হয়। বেগম খালেদা জিয়ার দুই সন্তান তারেক ও আরাফাত, দুই ভাই সাইদ এস্কান্দার ও শামীম এস্কান্দার এবং অন্য আত্মীয়রা ব্যাপকভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হন। তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা দুই রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও মোসাদ্দেক আলী ফালুর নগ্ন দুর্নীতি এখন সর্বত্র আলোচিত। তাদের দুর্নীতি আর দখলের যেসব কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে, তা একসময় অবিশ্বাস্য মনে হলেও সেসব এখন সত্য বলে সবাই মানছেন। বাংলাদেশের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের ব্যাপক দুর্নীতি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের স্বৈরশাসকদের দুর্নীতির কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। এসব দুর্নীতির নানা খবর এখনো প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
একই সঙ্গে ক্ষমতায় না থেকেও আওয়ামী লীগের নেতাদের চাঁদাবাজি আর দুর্নীতি-মনোনয়ন বাণিজ্যও দেশবাসীকে হতবাক করেছে। আমরা দেখেছি, তারা বিগত পাঁচ বছরে প্রতিবাদের অন্য সব পন্থাকে তেমন আমলে না নিয়ে কেবল লাগাতার হরতাল-অবরোধ, সংঘাত-সংঘর্ষের পথ বেছে নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল সরকার পতনের আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা ও পরের ওই বছর ৪ জুন হরতাল সফল করতে বাসে অগি্নসংযোগ করে ১১ জনকে হত্যা এবং পোশাক শিল্প-কারখানায় অরাজকতা সৃষ্টির অভিযোগসহ যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের বিস্মিত করেছে।
আমরা দেখতে পাই, পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে যে কোনো উপায়ে আবার ক্ষমতায় আসার জন্য বিএনপি কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে, প্রশাসনকে সম্পূর্ণভাবে দলীয়করণ করে, নির্বাচন কমিশনে নিজেদের লোক বসিয়ে এবং ভুলে ভরা ভোটার তালিকা করে তারা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে চেয়েছিল। একদিকে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য চারদলীয় জোটের নানা রকম চক্রান্তমূলক পদক্ষেপ, অন্যদিকে তা প্রতিহত করার জন্য আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর সর্বাত্মক প্রতিরোধ ক্রমেই সহিংস রূপ নিতে থাকে। ঢাকার রাজপথে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়। (আওয়ামী লীগ দাবি করে ৬৭ জনের প্রাণের বিনিময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেছে।) অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, মানুষের জীবনযাত্রা পর্যন্ত অচল হয়ে পড়ে। দুই নেত্রীর অনমনীয় মনোভাব ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হতে থাকে। এ রকম অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে।
আমরা দেখি, ২২ জানুয়ারির বাতিল হয়ে যাওয়া নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্ব, বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুর্নীতিপরায়ণ, সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত সাবেক সব মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকা থেকে এটা পরিষ্কার হয়েছিল, বিএনপিতে তারেকের সমর্থকদেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিএনপির মনোনয়ন পেতে প্রার্থীদের বিপুল টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল। অন্যদিকে, বিএনপির নেতারা গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে দলের খরচের নামে কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। বিদেশ থেকে টাকা পেয়েছেন। তাহলে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক_ এই কোটি কোটি টাকা দলের কোন খাতে খরচ করা হতো? তবে কি তা শেষ পর্যন্ত দলের পরিবর্তে ব্যক্তির পকেটেই জমা পড়েছে?
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগও বিজয়ী হতে মরিয়া অবস্থান নিয়ে দলীয় ও জোটের মনোনয়নের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য এক মনোনয়ন-বাণিজ্যে মেতে উঠেছিল। এতে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শেখ সেলিম, শেখ হেলাল প্রমুখ এই বিরাট মনোনয়ন-বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছিলেন। এরশাদকে মহাজোটে পেতে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে বেশি অর্থ দিতে সম্মত হয়েছিল। বিএনপির অগ্রিম দুই কোটির জায়গায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে সাড়ে তিন কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। বিএনপির প্রস্তাবিত ৫০-৬০ কোটি টাকার জায়গায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে গেলে এরশাদকে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা দেওয়ার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছিল। আরও বিস্ময়কর ছিল, আওয়ামী লীগের আদর্শ ও লক্ষ্য সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে তালেবান আদর্শের সমর্থক খেলাফত মজলিসকে মহাজোটে নেওয়া হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, ফতোয়াকে আইনসিদ্ধ করতে ওই দলের সঙ্গে হলো আওয়ামী লীগের সমঝোতা চুক্তি। সে জন্য আওয়ামী লীগ বিপুল অর্থ পেয়েছিল। এ কথা আওয়ামী লীগের নেতারাই বলছেন। চমকের এখানেই শেষ নয়, খেলাফত মজলিসের প্রার্থীদের জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিতে তাদের কাছ থেকেও ভালো অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়েছিল। এ সবকিছু হয়েছিল শেখ হাসিনার জ্ঞাতসারে। এ সবকিছুর পর দুই বড় দলের নেতাদের সম্পর্কে দেশের মানুষের সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরও গভীর হয়েছে।
দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পটভূমিতে দুই নেত্রীর ভবিষ্যৎ কি হবে, কি হওয়া উচিত_ তা নিয়ে এখন আবার ব্যাপক আলোচনা চলছে। তারা কি রাজনীতিতে থাকবেন, নাকি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন? আমরা জানি, শেখ হাসিনা ২৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদে আছেন। এই সময়কালে তিনি একবার (১৯৯৬-২০০১ সাল) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনবার সংসদে বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালন করেছেন। অন্যদিকে, বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৩ বছর ধরে দলীয় শীর্ষ পদে আছেন। তিনি দুবার ('৯৬-এর ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হিসাবে নেওয়া হয়নি) দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একবার পাঁচ বছরের জন্য সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। প্রশ্ন হলো, তারা আর কতদিন দলীয় প্রধানের দায়িত্বে থাকবেন?
দেশবাসীর কাছে বড় প্রশ্ন হলো, এতসব কিছুর পর দেশে কি আগের ধারাতেই প্রতিহিংসার রাজনীতি চলতে থাকবে, নাকি গণতান্ত্রিক ও সহনশীল ধারার রাজনীতি ফিরে আসবে? দেশের শাসন প্রক্রিয়ায় কি সন্ত্রাস-দুর্নীতি-পরিবারতন্ত্রের অসীম প্রভাব চলতে থাকবে, না অপেক্ষাকৃত সৎ, যোগ্য ও উন্নয়নকামী নেতৃত্ব শাসন ক্ষমতায় আসবে? এসব প্রশ্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমনি, তেমনি নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও এখন আলোচিত হচ্ছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুই দলের কোনো কোনো নেতা এখনো বলছেন, সংস্কার বা পরিবর্তন যা-ই করা হোক না কেন, তা দুই নেত্রীকে রেখেই করতে হবে। যদিও তারা ভালো করেই জানেন, তা কিছুতেই সম্ভব নয়। সংকটকালের মধ্যেই ভাই মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দারকে বিএনপির সহ-সভাপতি পদ দিয়ে বেগম জিয়া প্রমাণ করেছেন, সংস্কার বলতে তিনি পরিবারতন্ত্রই বোঝেন। শেখ হাসিনাও যা বলছেন, তাতেও তার কাছে তার পরিবারই প্রধান। অনেকে এমনও বলছেন, প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে দুই নেত্রী দলের ওপর তাদের যে নিরঙ্কুশ প্রভাব তৈরি করেছেন, যেভাবে অর্থ-প্রতিপত্তি ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন, তা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারবেন না।
১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে এশিয়া উইক-এর ওই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছিল, 'বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়েই এখনো জনপ্রিয় এবং এটি স্পষ্ট নয় যে, কে তাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন, তারা ক্ষমতা ছাড়বেন কিনা। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত, তা হলো_ তারা যদি তাদের নিয়ন্ত্রণ না ছাড়েন, তাহলে জাতিকে একটি শুভ সূচনা উপহার দিতে অন্য কোনো নেতা তৈরি হবে না। নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নটি হুমকির মুখে পড়বে। আর তা না হলে যখন-তখন হরতাল-সংঘর্ষের কারণে ভেঙে পড়া আইন-শৃক্সখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না। পাশাপাশি রাজনীতির প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসবে না।' এশিয়া উইক-এর ওই সম্পাদকীয় প্রকাশিত হওয়ার পর বিগত ১০ বছরে তো আমরা সেটাই দেখলাম। দেশে চলেছে দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের রাজত্ব। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যা ধ্বংস করা হয়নি। একই সঙ্গে চলেছে চরম প্রতিহিংসার রাজনীতি।
এশিয়াউইক-এর ওই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছিল, 'দায়িত্বশীল ও কার্যকর রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য প্রয়োজন সমঝোতা ও সহযোগিতা_ যা বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনা সন্দেহাতীতভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন, তা তাদের আয়ত্তে নেই। তারা এখন জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করতে পারেন তা হলো, রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো এবং তারা যা করতে পারেননি অন্যরা যাতে সেই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করতে পারেন, তার জন্য সুযোগ করে দেওয়া।' আমরাও একইভাবে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বলতে পারি, গত ১৬ বছরে আপনাদের দু'জনের ক্ষমতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতির অনেক অত্যাচার দেশবাসী নীরবে সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে। দয়া করে আপনারা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। নতুন নেতৃত্বকে সামনে আসার এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিন। দুর্নীতি আর অপশাসন ছাড়া আপনাদের দেশকে দেওয়ার মতো আর কিছু নেই!
ভবিষ্যতে নতুন নেতৃত্ব যদি আসে তবে তাদের সামনে থাকবে পাহাড়প্রমাণ চ্যালেঞ্জ। কারণ দুই নেত্রী প্রায় দেড় যুগ ধরে দেশজুড়ে যে দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের আখড়া গড়ে তুলেছেন, তা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। এখন সেখান থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা আর সুস্থ ধারা সূচনা করতে দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। যত তাড়াতাড়ি তারা এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তা দেশের জন্য ততই মঙ্গলজনক হবে।
কিছু দিন আগে আইন ও তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছিলেন, দুই দলের নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ীই সরকার দুই নেত্রীর ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ (দুই নেত্রীকে দেশের বাইরে পাঠানো) নিয়েছিল। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে পরামর্শদাতাদের নাম প্রকাশের অনুরোধ জানানো হয়। জবাবে মইনুল হোসেন পরামর্শদাতাদের নাম প্রকাশ না করে আবারও একই কথা বলেন। তবে তিনি বলেন, দুই নেত্রীকে দেশে রেখে বা দলের শীর্ষে রেখে সংস্কার করা যাবে কি যাবে না_ এ ব্যাপারে দলের মধ্যে দুই রকম মত থাকতেই পারে। তিনি নাম প্রকাশ করেন আর না-ই করেন, তার এ বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক ও সুধীমহলে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
তবে এ কথাটি সত্য, বিএনপি ও আওয়ামী লীগে এমন অনেক নেতা ও কর্মী রয়েছেন, যারা দলে সংস্কার চান, পরিবারতন্ত্রের অবসান চান, দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। তারা বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বেরও পরিবর্তন চান। তবে দুই নেত্রী দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে এসব কিছু হবে না বলে তারা মনে করেন। মাঠ পর্যায়ের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যেও এ রকম মনোভাব রয়েছে। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে দুই দলের ভেতরে ও বাইরে বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনাও হয়েছে। দুই দলেরই বড় নেতারা এ রকম মতামত ব্যক্ত করেছেন অপ্রকাশ্যে। তাদের কাছ থেকেই আমরা এসব কিছু শুনেছি, জেনেছি। কিন্তু তারা এতদিন প্রকাশ্যে কিছু বলতে বা কোনো অবস্থান নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেননি। তারা এখন কিছু কিছু কথা বলছেন।
সর্বশেষ, যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলের জেরার মুখে আইন-শৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক দুই বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং বড় ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য ও বক্তব্য থেকে দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির যেসব তথ্য বের হয়ে আসছে, তাতে আবার প্রধান দুই নেত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ কথা বেশ জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে, যারা দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছেন, যারা দলের জন্য ও নিজের জন্য বহু সম্পদ গড়ে তুলেছেন, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যা-খুনের সঙ্গে জড়িত; তাদের নেতৃত্বে রেখে দল বা দেশের জন্য কি লাভ হবে? ১৫ বছর ধরে সরকার ও বিরোধী দলে থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দেশকে প্রায় ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছেন। বিএনপির বিগত সরকার যারপরনাই ক্ষতি করেছে দেশের। ২২ জানুয়ারির নির্বাচন হলে দেশে আরও সর্বনাশ হতো। কোনোভাবে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের আরও ভয়ঙ্কর রূপ আমরা দেখতাম। আর কোনোভাবে আওয়ামী লীগ জিতে গেলে তারাও আগের রেকর্ড ভঙ্গ করত। তার সব লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল।
আমাদের মনে আছে, ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ব্যাংকক থেকে প্রকাশিত খ্যাতিসম্পন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন এশিয়া উইক-এ দুই নেত্রীকে নিয়ে একটি সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল। 'একটি নতুন শুরু' (এ নিউ স্টার্ট) শিরোনামের নিচে দ্বিতীয় শিরোনাম ছিল 'বাংলাদেশের বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার সরে দাঁড়ানো উচিত'। ওই সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়েরই মে মাসে ('৯৬ সাল) অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি্বতা না করে রাজনীতি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। এ সম্পাদকীয় মন্তব্য নিয়ে তখন এবং পরবর্তীকালেও কিছু আলোচনা হয়েছিল। এ সম্পাদকীয় লেখার পটভূমি ছিল '৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপির ব্যর্থ শাসন, অকার্যকর সংসদ, আওয়ামী লীগের সংসদ বর্জনসহ হরতাল-অবরোধ ও একগুঁয়ে বিরোধিতা, দেশব্যাপী সংঘাত-সংঘর্ষ, প্রধান বিরোধী দলের বর্জন সত্ত্বেও মধ্য ফেব্রুয়ারির বিএনপির নির্বাচনী প্রহসন ও জনগণের প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি।
আমাদের মনে আছে, '৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগ কখনো বিএনপি সরকারকে মেনে নেয়নি। শুরু থেকে সরকার পতনের লক্ষ্যে তারা তাদের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। '৯৪ সাল থেকে অব্যাহতভাবে সংসদ বর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ। তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল দুর্নীতিপরায়ণ জাতীয় পার্টি ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী। হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে তৎকালীন বিএনপি সরকারের পুরো মেয়াদ পর্যন্ত সব সময় দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা হয়েছিল। ওই সময়ে সংঘাত-সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। আর বিএনপির শাসন-পরবর্তী সময়ের (২০০১-২০০৬) চেয়ে তখন কিছুটা সহনশীল হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা ও দুর্নীতির বহু অভিযোগ উঠেছিল।
আমাদের মনে আছে, শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন বাতিল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিতে এবং আবার সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। তারা ক্ষমতায় এসে আগের পাঁচ বছরে বিএনপি যা যা করেছিল তারই পুনরাবৃত্তি করে, তবে আরও বেশি মাত্রায়। শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, প্রশাসনের দলীয়করণ, বিরোধী দলকে অগ্রাহ্য করা ও দমন-পীড়ন চালানো প্রায় সবই হয়েছিল। এর সব কিছুতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলীয় নেতা-মন্ত্রীরা সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপিও আওয়ামী লীগের মতোই একইভাবে হরতাল-অবরোধ, সংসদ বর্জন, সংঘাত-সংঘর্ষের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করেছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্থবির করেছে, দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সর্বশেষ, ২০০১ সালে আবার বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। কিন্তু চরিত্রের কোনো বদল হয়নি। বরং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নেতৃত্বে অর্থ-সম্পদ বিত্তের আকাক্সক্ষা আরও উদগ্র রূপ নেয়। শুরুতেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। দুর্নীতি লাগামহীন হয়ে পড়ে। প্রশাসনে নির্লজ্জ দলীয়করণ করা হয়। নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, বিচার বিভাগসহ কোনো কিছুই চরম দলীয়করণ থেকে রক্ষা পায়নি। সারাদেশে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বন্যা বয়ে যায়। খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার নেতৃত্বে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতারা দেশব্যাপী নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, লুট, জমি দখল ও দেশি-বিদেশি সূত্রে শত-সহস কোটি টাকা সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়েন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় ধর্মীয় জঙ্গিবাদ, দেশব্যাপী বোমা- গ্রেনেড হামলা প্রভৃতি। এগুলোর পেছনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আমরা দেখতে পাই। বিরোধীদলীয় নেতার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২২ নেতাকর্মীর মৃত্যু ও তিন শতাধিক লোকের আহত হওয়া, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ অনেক বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে হত্যার ঘটনায় আমরা তদন্ত আর বিচারের নামে প্রহসন দেখতে পেয়েছি। সন্ত্রাস-দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ দলের সর্বোচ্চ পর্যায়কে সরাসরি জড়িত হতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও ব্যবহৃত হয়। বেগম খালেদা জিয়ার দুই সন্তান তারেক ও আরাফাত, দুই ভাই সাইদ এস্কান্দার ও শামীম এস্কান্দার এবং অন্য আত্মীয়রা ব্যাপকভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হন। তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা দুই রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও মোসাদ্দেক আলী ফালুর নগ্ন দুর্নীতি এখন সর্বত্র আলোচিত। তাদের দুর্নীতি আর দখলের যেসব কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে, তা একসময় অবিশ্বাস্য মনে হলেও সেসব এখন সত্য বলে সবাই মানছেন। বাংলাদেশের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের ব্যাপক দুর্নীতি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের স্বৈরশাসকদের দুর্নীতির কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। এসব দুর্নীতির নানা খবর এখনো প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
একই সঙ্গে ক্ষমতায় না থেকেও আওয়ামী লীগের নেতাদের চাঁদাবাজি আর দুর্নীতি-মনোনয়ন বাণিজ্যও দেশবাসীকে হতবাক করেছে। আমরা দেখেছি, তারা বিগত পাঁচ বছরে প্রতিবাদের অন্য সব পন্থাকে তেমন আমলে না নিয়ে কেবল লাগাতার হরতাল-অবরোধ, সংঘাত-সংঘর্ষের পথ বেছে নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল সরকার পতনের আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা ও পরের ওই বছর ৪ জুন হরতাল সফল করতে বাসে অগি্নসংযোগ করে ১১ জনকে হত্যা এবং পোশাক শিল্প-কারখানায় অরাজকতা সৃষ্টির অভিযোগসহ যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা আমাদের বিস্মিত করেছে।
আমরা দেখতে পাই, পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে যে কোনো উপায়ে আবার ক্ষমতায় আসার জন্য বিএনপি কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে, প্রশাসনকে সম্পূর্ণভাবে দলীয়করণ করে, নির্বাচন কমিশনে নিজেদের লোক বসিয়ে এবং ভুলে ভরা ভোটার তালিকা করে তারা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে চেয়েছিল। একদিকে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য চারদলীয় জোটের নানা রকম চক্রান্তমূলক পদক্ষেপ, অন্যদিকে তা প্রতিহত করার জন্য আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর সর্বাত্মক প্রতিরোধ ক্রমেই সহিংস রূপ নিতে থাকে। ঢাকার রাজপথে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়। (আওয়ামী লীগ দাবি করে ৬৭ জনের প্রাণের বিনিময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেছে।) অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, মানুষের জীবনযাত্রা পর্যন্ত অচল হয়ে পড়ে। দুই নেত্রীর অনমনীয় মনোভাব ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হতে থাকে। এ রকম অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে।
আমরা দেখি, ২২ জানুয়ারির বাতিল হয়ে যাওয়া নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্ব, বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দুর্নীতিপরায়ণ, সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত সাবেক সব মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকা থেকে এটা পরিষ্কার হয়েছিল, বিএনপিতে তারেকের সমর্থকদেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিএনপির মনোনয়ন পেতে প্রার্থীদের বিপুল টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল। অন্যদিকে, বিএনপির নেতারা গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে দলের খরচের নামে কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। বিদেশ থেকে টাকা পেয়েছেন। তাহলে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক_ এই কোটি কোটি টাকা দলের কোন খাতে খরচ করা হতো? তবে কি তা শেষ পর্যন্ত দলের পরিবর্তে ব্যক্তির পকেটেই জমা পড়েছে?
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগও বিজয়ী হতে মরিয়া অবস্থান নিয়ে দলীয় ও জোটের মনোনয়নের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য এক মনোনয়ন-বাণিজ্যে মেতে উঠেছিল। এতে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শেখ সেলিম, শেখ হেলাল প্রমুখ এই বিরাট মনোনয়ন-বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছিলেন। এরশাদকে মহাজোটে পেতে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে বেশি অর্থ দিতে সম্মত হয়েছিল। বিএনপির অগ্রিম দুই কোটির জায়গায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে সাড়ে তিন কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। বিএনপির প্রস্তাবিত ৫০-৬০ কোটি টাকার জায়গায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে গেলে এরশাদকে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা দেওয়ার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছিল। আরও বিস্ময়কর ছিল, আওয়ামী লীগের আদর্শ ও লক্ষ্য সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে তালেবান আদর্শের সমর্থক খেলাফত মজলিসকে মহাজোটে নেওয়া হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, ফতোয়াকে আইনসিদ্ধ করতে ওই দলের সঙ্গে হলো আওয়ামী লীগের সমঝোতা চুক্তি। সে জন্য আওয়ামী লীগ বিপুল অর্থ পেয়েছিল। এ কথা আওয়ামী লীগের নেতারাই বলছেন। চমকের এখানেই শেষ নয়, খেলাফত মজলিসের প্রার্থীদের জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিতে তাদের কাছ থেকেও ভালো অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়েছিল। এ সবকিছু হয়েছিল শেখ হাসিনার জ্ঞাতসারে। এ সবকিছুর পর দুই বড় দলের নেতাদের সম্পর্কে দেশের মানুষের সন্দেহ ও অবিশ্বাস আরও গভীর হয়েছে।
দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পটভূমিতে দুই নেত্রীর ভবিষ্যৎ কি হবে, কি হওয়া উচিত_ তা নিয়ে এখন আবার ব্যাপক আলোচনা চলছে। তারা কি রাজনীতিতে থাকবেন, নাকি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন? আমরা জানি, শেখ হাসিনা ২৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদে আছেন। এই সময়কালে তিনি একবার (১৯৯৬-২০০১ সাল) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনবার সংসদে বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালন করেছেন। অন্যদিকে, বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৩ বছর ধরে দলীয় শীর্ষ পদে আছেন। তিনি দুবার ('৯৬-এর ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হিসাবে নেওয়া হয়নি) দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একবার পাঁচ বছরের জন্য সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। প্রশ্ন হলো, তারা আর কতদিন দলীয় প্রধানের দায়িত্বে থাকবেন?
দেশবাসীর কাছে বড় প্রশ্ন হলো, এতসব কিছুর পর দেশে কি আগের ধারাতেই প্রতিহিংসার রাজনীতি চলতে থাকবে, নাকি গণতান্ত্রিক ও সহনশীল ধারার রাজনীতি ফিরে আসবে? দেশের শাসন প্রক্রিয়ায় কি সন্ত্রাস-দুর্নীতি-পরিবারতন্ত্রের অসীম প্রভাব চলতে থাকবে, না অপেক্ষাকৃত সৎ, যোগ্য ও উন্নয়নকামী নেতৃত্ব শাসন ক্ষমতায় আসবে? এসব প্রশ্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমনি, তেমনি নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও এখন আলোচিত হচ্ছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুই দলের কোনো কোনো নেতা এখনো বলছেন, সংস্কার বা পরিবর্তন যা-ই করা হোক না কেন, তা দুই নেত্রীকে রেখেই করতে হবে। যদিও তারা ভালো করেই জানেন, তা কিছুতেই সম্ভব নয়। সংকটকালের মধ্যেই ভাই মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দারকে বিএনপির সহ-সভাপতি পদ দিয়ে বেগম জিয়া প্রমাণ করেছেন, সংস্কার বলতে তিনি পরিবারতন্ত্রই বোঝেন। শেখ হাসিনাও যা বলছেন, তাতেও তার কাছে তার পরিবারই প্রধান। অনেকে এমনও বলছেন, প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে দুই নেত্রী দলের ওপর তাদের যে নিরঙ্কুশ প্রভাব তৈরি করেছেন, যেভাবে অর্থ-প্রতিপত্তি ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন, তা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারবেন না।
১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে এশিয়া উইক-এর ওই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছিল, 'বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়েই এখনো জনপ্রিয় এবং এটি স্পষ্ট নয় যে, কে তাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন, তারা ক্ষমতা ছাড়বেন কিনা। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত, তা হলো_ তারা যদি তাদের নিয়ন্ত্রণ না ছাড়েন, তাহলে জাতিকে একটি শুভ সূচনা উপহার দিতে অন্য কোনো নেতা তৈরি হবে না। নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নটি হুমকির মুখে পড়বে। আর তা না হলে যখন-তখন হরতাল-সংঘর্ষের কারণে ভেঙে পড়া আইন-শৃক্সখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না। পাশাপাশি রাজনীতির প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসবে না।' এশিয়া উইক-এর ওই সম্পাদকীয় প্রকাশিত হওয়ার পর বিগত ১০ বছরে তো আমরা সেটাই দেখলাম। দেশে চলেছে দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের রাজত্ব। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যা ধ্বংস করা হয়নি। একই সঙ্গে চলেছে চরম প্রতিহিংসার রাজনীতি।
এশিয়াউইক-এর ওই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছিল, 'দায়িত্বশীল ও কার্যকর রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য প্রয়োজন সমঝোতা ও সহযোগিতা_ যা বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনা সন্দেহাতীতভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন, তা তাদের আয়ত্তে নেই। তারা এখন জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করতে পারেন তা হলো, রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো এবং তারা যা করতে পারেননি অন্যরা যাতে সেই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করতে পারেন, তার জন্য সুযোগ করে দেওয়া।' আমরাও একইভাবে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বলতে পারি, গত ১৬ বছরে আপনাদের দু'জনের ক্ষমতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতির অনেক অত্যাচার দেশবাসী নীরবে সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে। দয়া করে আপনারা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। নতুন নেতৃত্বকে সামনে আসার এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিন। দুর্নীতি আর অপশাসন ছাড়া আপনাদের দেশকে দেওয়ার মতো আর কিছু নেই!
ভবিষ্যতে নতুন নেতৃত্ব যদি আসে তবে তাদের সামনে থাকবে পাহাড়প্রমাণ চ্যালেঞ্জ। কারণ দুই নেত্রী প্রায় দেড় যুগ ধরে দেশজুড়ে যে দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের আখড়া গড়ে তুলেছেন, তা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। এখন সেখান থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা আর সুস্থ ধারা সূচনা করতে দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। যত তাড়াতাড়ি তারা এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তা দেশের জন্য ততই মঙ্গলজনক হবে।
মাননীয় দুই নেত্রী, ওয়ান-ইলেভেনে নির্জন কারাপ্রকোষ্ঠে বসে মতিউরকে মনে পড়েছিল? সেই মতিউর রহমান যিনি মস্কোর সমাজতন্ত্রের সুগন্ধি ছড়িয়ে নেতাজী শুভাষ চন্দ্র বসু থেকে জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবীদের কিংবদন্তির গল্প শুনিয়ে পার্টির কমরেড ও প্রেমিকার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সূচনা করেছিলেন। কত বিপ্লবী কমরেডের মরদেহ সামনে রেখে যিনি আজীবন সমাজতন্ত্রের লাল পতাকা ওড়ানোর শপথ নিয়েছিলেন কিন্তু বিপ্লব দূরে থাক মুক্তিযুদ্ধে কোন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়নি।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ বঙ্গবন্ধুর ছায়ায় আওয়ামী লীগের হেরেমে প্রবেশ করলেও মতিউরের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। কথিত আছে, সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের কিংমেকার জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে মতিউর রহমান কমিউনিস্ট পার্টিকে খাল কাটায় ঠেলে দিয়েছিলেন।
তার জীবনের পথে পথে বিশ্বাসঘাতকতার একের পর এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সেনাশাসক এরশাদ জামানায় জেনারেল চিস্তির গোপন আজ্ঞাবহ দাস হয়েও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রেস, পত্রিকা ও জায়গা বরাদ্দের আবদার নিয়ে ঘুরেছিলেন। দেশি-বিদেশি নানা মহলের অন্দরে যাতায়াতের একপর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এমনকি নিরন্ন মানুষের সঙ্গে দু মুঠো খাবার, মাথা গোঁজার ঠাঁই ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা যিনি চেয়েছিলেন। লোভ-লালসার ঊধর্ে্ব উঠে কমরেড তাজুলের রক্ত ছুঁয়ে শপথ নিলেও পরবর্তীতে নানা অন্ধকার গলি ঘুরে রাতারাতি বুর্জোয়া গণতন্ত্রী হয়ে যান তিনি।
মুসলমান দেশে মধ্যদুপুরে গাজীপুরের এক বাগানবাড়িতে কোকিলের ডাক শুনে দুই-একজন লেখকের সঙ্গে বিদেশি মদের গ্লাসে চুমুক দেওয়ার ছবি যেমন দেখা যায় তেমনি শোনা যায় রাতের আঁধারে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের কাদের মোল্লার জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিদের সঙ্গে গভীর সখ্যে মেতে ওঠার খবর। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে কোনো কোনো মহল থেকে মিসকিনি সুযোগ-সুবিধা পেলেও ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে বড় ধরনের আবদার করে ব্যর্থ হন।
ভোরের কাগজে সুবিধা করতে না পেরে প্রথম আলো বের করে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের প্রতি প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে ওঠেন মতিউর রহমান ও তার মনিব, বিতর্কিত ব্যবসায়ী লতিফুর রহমান। ২০০১ সালের নির্বাচনে লতিফের টাকা আর মতিউরের চতুরতা যোগ হয় ধানের শীষের পক্ষে। কিন্তু স্বার্থ হাসিল না হলেই মতিউরের স্বভাব চরিত্রহনন।
খালেদা বা পুত্র তারেক রহমানের কাছে স্বার্থ আদায় না হওয়ায় উলফা ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত লতিফ-মতিউর জুটি বিএনপি সরকারের সঙ্গেই নয়, যেন দেশ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক অশুভ খেলায় নেমে যান। একসময় খদ্দর পরা যে মতিউর লাল বই বগলে নিয়ে হাঁটতেন, ফাইভস্টার হোটেলে যাওয়া মানুষকে দুশমন ভাবতেন, সেই মতিউরকে দেখা যায় ফাইভস্টার হোটেলের সুইমিং, জিম ও পানশালায়। পরনে ব্র্যান্ডের টি-শার্ট ও হাফপ্যান্ট।
বাপ নিজেই নয়, ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রভাব খাটিয়ে ছেলেকেও এখন বড় ব্যবসায়ী বানিয়েছেন। মতিউর দেশি-বিদেশি নানা মহলের সঙ্গে গভীর ষড়যন্ত্রেই লিপ্ত হননি পাকিস্তানি এক প্রখ্যাত সাংবাদিকের মাধ্যমে ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গেও একটি পরোক্ষ সম্পর্ক গড়েছিলেন। সম্পর্ক কোন ধরনের তা জানা না গেলেও শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার অংশীদার জঙ্গি তাজউদ্দিনের সঙ্গে যে সম্পর্ক তা মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়েছে। যেখানেই স্বার্থসিদ্ধি হয় না সেখানেই নষ্টভ্রষ্ট কমিউনিস্ট মতিউরের হাতিয়ার হয়ে ওঠে কাশিমবাজার কুঠির দৈনিক প্রথম আলো।
মরহুম স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর রুচিতে ঠাঁই না পাওয়ায় মতিউর তার পত্রিকা ব্যবহার করেছিলেন। স্পিকার আইনের পথ শক্তভাবে নিতে গেলে কমিউনিস্ট মতিউর আশ্রয় নেন উদার গণতন্ত্রী ও প্রখ্যাত সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর। মতিউর রহমান চৌধুরী ছিলেন হুমায়ুর রশীদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন। তাই নয়, খালেদা জিয়ার চারদলীয় জোটের নানা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লেখার জন্য ২০০১ সালের আগে যে মতিউর রহমান মরহুম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের গুলশানের বাড়ির বারান্দায় বসে থাকতেন ডিকটেশন নেওয়ার জন্য। বিএনপি জোট শাসনামলে লতিফুর-মতিউরের স্বার্থ হাসিল না হওয়ায় সাইফুর রহমানের গুষ্টিশুদ্ধ চরিত্রহননে নামেন তিনি।
জনগণের কাছে দুই নেত্রী, দুই পরিবার ও রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহননের ঝকঝকে অত্যাধুনিক প্রকাশনার এক ব্রডশিট বুকলেট হয়ে ওঠে অন্ধকার জগতের প্রথম আলো। নিরীহ, নিরহঙ্কারী, ভদ্র-বিনয়ী সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হলে এই মতিউর রহমান হলুদ সাংবাদিকতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে 'বোমা মানিক' বানিয়ে প্রথম আলোয় নিরন্তর প্রচার চালান। মানিক যখন জেলে তখন তার শিশুসন্তানকে বলা হতো বাবা তোমার লন্ডনে। স্কুলে বাচ্চা ও মিসদের কাছে তার বাবা বোমা মানিক হয়েছিলেন, প্রথম আলোর গুণে।
প্রথম আলো এভাবে দেশের একজন সংসদ সদস্যকে বোমা মানিক বানিয়ে আন্তর্জাতিক ময়দানে হাসিনাকে ছোট করেছিল। ছোট করেছিল এ দেশের রাজনীতিকে। কিন্তু উচ্চ আদালত যখন সংসদ সদস্য মানিককে নিরপরাধ হিসেবে খালাস দিলেন তখন প্রথম আলো আর বোমা মানিক লিখল না। মতিউর রহমান মানিকের চরিত্রহননের জন্য তার কাছে বা পাঠকের কাছে ক্ষমাও চাইলেন না। তাদের ষড়যন্ত্রের পথ উন্মোচিত হলো। মঞ্চে নাটক জমে উঠল।
ওয়ান-ইলেভেন এল হাঁকডাক করে। নেপথ্য কুশীলবদের সঙ্গে শয়তানের হাসি হাসলেন মতিউর রহমান। তখন তিনিই ওয়ান-ইলেভেন সরকারের থিঙ্কটাঙ্ক। তার পরামর্শ নেয় ফখরুদ্দীন সরকার। কে হবেন প্রেসসচিব, কে কোন মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন তা মতিউরই নির্ধারণ করতেন। দিন-রাত নানা তৎপরতায় ব্যস্ত মতিউর শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এ দেশের মাটি, মানুষ ও রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করার পাকিস্তানি মাইনাস টু ফর্মুলা নিয়ে জিহাদে নামেন। খালেদা জিয়ার সন্তানদের ওপর, ব্যবসায়ীদের ওপর, রাজনীতিবিদদের ওপর অকথ্য নির্যাতন নেমে আসে। শেখ হাসিনাকে দেশে আসতে না দেওয়া, খালেদা জিয়াকে জোর করে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়ে ঢাকায় লতিফুর প্রযোজিত মতিউর পরিচালিত প্রথম আলোর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার শ্বাসরুদ্ধকর নাটকীয় ঘটনা শুরু হয়। দুই নেত্রীকে বিদেশে পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেনেহেঁচড়ে কারাগারে নেওয়া হয়। নেওয়া হয় খালেদা জিয়াকেও। মতিউর সেদিন লিখেছিলেন, 'দুুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে'।
তিনি দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য অগণতান্ত্রিক যুক্তি তুলে ধরে বলেন, 'সুস্থ ধারার সূচনা করতে দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। তাড়াতাড়ি হলে দেশের জন্য মঙ্গল।' সেদিন দুই নেত্রীর প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করে যারা ঘরে-বাইরে দুঃখ-বেদনা, ক্ষোভ, অশ্রু, আবেগ প্রকাশ করেছিলেন তারা অবাক বিস্ময়ে দেখলেন বহুরূপী মতিউর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সম্পাদক কিংবা সাংবাদিকদের সঙ্গে আমন্ত্রণ জানিয়ে মেহমানের মর্যাদা দিয়ে চা পান করানো হচ্ছে।
আবার বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার দরবারেও সিনিয়র সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভায় লাজলজ্জার খোলস ছেড়ে মতিউর দাঁড়িয়ে নসিহত করেন 'আপনারা হরতাল দেবেন না'। হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ! দুই নেত্রী জেল খাটেন। দুর্নীতির কলঙ্ক নেন। কারাগারে তাদের বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা হয়।
রাজনীতিবিদদের রিমান্ড, জেল, নির্যাতন, মামলার মুখে পড়তে হয়। দুই নেত্রীর দুঃসময়ের পাশে থাকা বড় বড় ব্যবসায়ী জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন। দুই নেত্রীর আত্মীয়স্বজনরা নির্যাতিত হন। কিন্তু ফড়িয়া মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী লতিফুর রহমান ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের চলমান এক শয়তানের প্রতীক মতিউর রহমান ধরাছোঁয়ার বাইরেই নয়, রীতিমতো তাদের দুই নেত্রীর কাছাকাছি মাঝেমধ্যেই ডেকে নেওয়া হয়! টিভির পর্দায় দুই নেত্রীর কাছাকাছি মতিউরকে দেখে মানুষের মনে প্রশ্ন, জনগণের শক্তি দুই নেত্রীর চেয়েও কি লতিফ-মতিউর ক্ষমতাবান? কী তাদের ক্ষমতার উৎস?
মাননীয় দুই নেত্রী মানুষের বড্ড জানতে ইচ্ছে করে_ আপনারা যখন কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়েছিলেন তখন কি মনে পড়েছিল বাইরে আপনাদের রাজনীতির কবর খুঁড়তে মতিউর রহমান কী করছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন