শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

নিরস্ত্র জনতার ওপর বেপরোয়া গুলি

বিরোধী আন্দোলন দমাতে সরকারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনতার ওপর বেপরোয়া গুলি চালিয়ে দেশে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গত ৯ দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী ছাড়া সাধারণ নাগরিক ও পথচারীও রয়েছেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও সহস্রাধিক ব্যক্তি। এদের মধ্যে অন্তত ২৫ জন সাংবাদিক রয়েছেন। শুধু গত শুক্রবার রাজধানীসহ সারাদেশে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন পাঁচ শতাধিক মুসল্লি। এর আগে সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে আন্দোলনকারীদের ভয় দেখিয়ে ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়া হলেও বর্তমানে চলছে ফ্রিস্টাইলে গুলিবর্ষণ। কঠিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জনতার ওপর গুলি ছোড়ার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতির বিধান থাকলেও বর্তমানে সে নির্দেশ উপেক্ষিত। অনেক সময় খুব কাছে থেকে শরীরে পিস্তল ও বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করছে পুলিশ। গত শুক্রবার রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদে নামাজ শেষে মুসল্লিদের পূর্বঘোষিত বিক্ষোভের সংবাদ ও ছবি সংগ্রহ করতে গেলে মুসল্লিদের পাশাপাশি সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছোড়ে পুলিশ। এ সময় সাংবাদিকরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে রাস্তায় শুয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেও পুলিশের চালানো বেপরোয়া গুলি থেকে রেহাই পায়নি। এছাড়া ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন ভবনে কোনো কারণ ছাড়াই ব্যাপক গুলি ছোড়ে পুলিশ।
কক্সবাজারে ৪ : গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে কক্সবাজার শহরে সাঈদী মুক্তি পরিষদ আয়োজিত সর্বস্তরের মানুষের মিছিলে পুলিশ নির্বিচার গুলি চালায়। গুলিতে চারজন নিহত ও দেড় শতাধিক গুলিবিদ্ধ হন। নিহতরা হলেন সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের জামায়াতকর্মী নুরুল হক (৪২), পিএমখালী ইউনিয়নের মোক্তার আহমদের ছেলে মোহাম্মদ আবদুল্লাহ (৪২), শহরতলীর গোদারপাড়ার কলিম উল্লাহর ছেলে শিবিরকর্মী তোফায়েল উদ্দিন (২২) ও ছালেহ আহমদ (৪৫)। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জেলা প্রশাসন কক্সবাজার শহরে ওইদিন বিকাল সাড়ে চারটা থেকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে জামায়াত-শিবিরের তিন কর্মীসহ চারজন নিহত হওয়ার প্রতিবাদে পরদিন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে জামায়াত। 
কুমিল্লায় ১ : গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হরতালের সময় কুমিল্লায় জাময়াত-শিবির কর্মীদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ইব্রাহীম নামে এক জামায়াত কর্মী নিহত হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে তার মৃত্যু হয়। এ সময় ৩ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় আরও ২৫ জন। জামায়াতকর্মী নিহতের প্রতিবাদে জেলা জামায়াত পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় আধাবেলা হরতাল পালন করে। নিহত ইব্রাহীম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। গুলিবিদ্ধ গুরুতর আরও দুইজন হলেন, শিবিরকর্মী চৌদ্দগ্রামের দুর্গাপুর গ্রামের কবির আহমদের ছেলে এনায়েত ও লুদিয়ারা গ্রামের মুকবুল হোসেনের ছেলে নাঈম উদ্দিন মুরাদ। 
গাইবান্ধায় ৩ : গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইসলাম ও নবী (সা.)-কে অবমাননার প্রতিবাদ ও ধর্মদ্রোহী নাস্তিক, মুরতাদদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ফুঁসে ওঠা ইসলামী জনতার মহাজাগরণ দমাতে নির্বিচার গুলি চালালে গাইবান্ধায় তিন মুসল্লি নিহত হন। এরা হলেন গোবিন্দপুরের শিবিরকর্মী মোমিন ও মুঞ্জু এবং মহদিপুর ইউনিয়নের যুবদলের সাধারণ সম্পাদক কোকিল। এছাড়া ২৫ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় অন্তত ৫০ জন। শুক্রবার জুমা নামাজ শেষে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে সমমনা কয়েকটি ইসলামী দলের কয়েক হাজার লোক মিছিল করে রংপুর-বগুড়া মহাসড়ক অবরোধ করলে পুলিশ বিনা উসকানিতে ৩০ রাউন্ড গুলি চালায়। এতে ২ জন ঘটনাস্থলে এবং হাসপাতালে নেয়ার পথে মোমিন নামে আরও একজন মারা যান। এ সময় কমপক্ষে ২০ জনকে আটক করে পুলিশ।
সিলেটে ১ : একই দিন বাদ জুমা সিলেটে তৌহিদি জনতার মিছিলে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে মোস্তফা মুর্শেদ তাহসীন (১৮) নামে এক যুবক নিহত হয়। নিহতের বাবা নুরুল মোস্তফা জালালাবাদ গ্যাসে কর্মরত। এম সি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র তাহসীন জুমার নামাজ শেষে হাউজিং এস্টেট মসজিদ থেকে মুসল্লিদের মিছিলে অংশ নেয় এবং চৌহাট্টায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। এ সময় কমপক্ষে ৫০ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হন। এর পর নগরীর চৌহাট্টা পয়েন্ট ও সংলগ্ন সড়কগুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এছাড়া এদিন রাজধানীসহ রাজশাহী, ঝিনাইদহ, সিলেট, কুমিল্লা, বগুড়া, পাবনা, পট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে অন্তত সাত শতাধিক মুসল্লি ও সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হন।
পাবনায় ২ : সর্বশেষ গতকাল পাবনায় জামায়াতের ডাকা অর্ধদিবস হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে দুই জামায়াত কর্মী নিহত হন। নিহতরা হলো ধর্মগ্রাম এলাকার শমশের আলীর ছেলে আলাল হোসেন (১৮) ও মনোহরপুর এলাকার আবদুল কুদ্দুসের ছেলে সিরাজুল ইসলাম (২৩)। গুলিবিদ্ধ আরও ২ জনের অবস্থা আশঙ্কজনক হওয়ায় তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। গতকাল সকাল ৮টার দিকে সদর উপজেলার পাবনা-ঢাকা মহাসড়কের বাঙ্গাবাড়িয়া এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজিবি ও রেঞ্জরিজার্ভ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া ২৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দুই কর্মী নিহতের প্রতিবাদে জামায়াত আজ বিক্ষোভ কর্মসূচি ও সোমবার দোয়া দিবস ঘোষণা করেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন